আচরণগত অক্ষম শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ কৌশল | Teaching strategies for Behavioural Disabled Students ||
আচরণগত অক্ষম শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ কৌশল | Teaching strategies for Behavioural Disabled Students
মানুষ সামাজিক জীব।সমাজে সবাই সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করবে এটাই সমাজের রীতি বা নিয়ম।কিছু কিছু অস্বাভাবিক আচরণ সমাজে ব্যতিক্রমী কিছু প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা এই প্রতিবেদনে আচরণগত সমস্যায় যেসব শিশুরা আক্রান্ত তাদের শিখন কৌশল প্রয়োগ করে কিভাবে স্বাভাবিকদের মতো নিয়ে আসা যায় সে বিষয়ে জানবো।
আচরণগত অক্ষমতা কি?
IDEA এর মতে Behavioral Disorder হলো এমন এক ধরনের অবস্থা যেখানে নিমোক্ত এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে যা শিশুর শিক্ষার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ
১.বন্ধুদের সাথে শিক্ষকদের সাথে, সহপাঠী, আত্নীয় -স্বজন,প্রতিবেশীর সাথে সন্তোষজনক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না।
২.স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক আচরণ করে।
৩.সবসময় অসুখী মেজাজে থাকে।
৪.সর্বদা নিজেদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে নেয়। সব কিছুতে ভয় থাকে।
আরো পড়ুনঃ
শিখন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ কৌশল ||
আচরণগত অক্ষমতার বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
আচরণগত অক্ষমতা শুধু যে আবেগীয় ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করবে তার কিন্তু নয়।বরং একজন ব্যক্তির শারীরিক, সামাজিক বা ঙ্গানীয় ক্ষেত্রসমূহ ও আচরণগত অক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।যেমনঃ
১.অতি চঞ্চল ( দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ রাখতে পারে না)
২.আক্রমণান্তক বা আত্মঘাতী আচরণ করে।
৩.স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক আচরণ করা।
৪.বেশির ভাগ সময়ই অসুখী বা হতাশ থাকে।
৫.একাডেমিক সাফল্য খুব কম।
আচরণগত অক্ষমতার কারণঃ
১.Physical Illness or Disability:
শারীরিক অসুস্থতা বা বিভিন্ন ধরনের অক্ষমতা থেকে Behavioural Disorder হতে থাকে।
২.Malnutrition:
অনেকসময় অপুষ্টির কারণেও Behavioural Disorder হতে পারে।কারণ অপুষ্টির কারণে বাচ্চা বা শিশুর বিকাশ ব্যাহত হয়।
৩.Brain Damage:
মস্তিষ্কের আঘাতের ফলে শিশুদের Behavioural Disorder হতে পারে।এটির কারণে শিশুরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে যা তাদের আচরণকে প্রভাবিত করে।
৪.Hereditary Factors:
Behavioural problem বংশগত হতে পারে। পরিবারে পিতা-মাতা যদি পূর্বে এই সমস্যায় সম্মুখীন হন তাহলে শিশুরা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়।
আচরণগত অক্ষমতার কিছু ধরন রয়েছেঃ
- ADHD=Attention Deficit Hyperactivity Disorder
- ODD=Oppositional Defient Disorder
- CD=Conduct Disorder
- OCD=Obsessive Compulsive Disorder
আরো পড়ুনঃ
ব্যতিক্রমধর্মী শিশু কারা? এদেরকে আমরা কিভাবে সনাক্ত করবো?
ADHD(Attention Deficit Hyperactivity Disorder):
ADHD হলো মনোযোগের ঘাটতির ব্যাধি।যেটি হলে মস্তিষ্কের কাজ করার সাধারণ বিকাশীয় ব্যাধি যা সচারাচর শৈশবেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায়ও থাকতে পারে।এটি মস্তিষ্কের বিকাশ ও কার্যক্রমকে ব্যাহত করে।ADHD যুক্ত শিশুরা সাধারণত বেশি উদ্যমী/চঞ্চল হয়,মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না এবং কাজের পরিণতির কথা না ভেবেই কাজ করে।
ADHD শিশুদের শিখন শেখানো কৌশলঃ
১.শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন এলাকা এবং দূরে দরজা এবং জানালা Distractions থেকে দূরে বসাতে হবে।
২.শিক্ষার্থীর কাজের চাপের দৈর্ঘ্য হ্রাস করা যাতে মনোযোগ হারিয়ে না যায়।
৩.কারো সাথে শিশু নিজের খেলনা শেয়ার করলে বা অপরিচিত কাউকে সালাম প্রদর্শন, হ্যাঁ উল্লেখ এরুপ ভালো আচরণের জন্য শিশুকে সেই সময়ই পুরষ্কার প্রদান করা।
৪.শিশুকে ক্লাসরুমের মাঝে বসার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে চারপাশে খুব একটা নড়াচড়া করার বা বাইরে দিকে তাকিয়ে থাকার সুযোগ না থাকে।
ADHD শিশুদের জন্য অতিরিক্ত সময়ের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সে নিজের কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারে।
৬.কঠিন কাজগুলো সকালের দিয়ে কিংবা টিফিনের পর দিতে হবে।
৭.টাস্ক বা কাজগুলো ছোট ছোট করে ভাগ করে দিতে হবে।
৮.যদি সম্ভব হয় প্রতি ADHD শিশুর জন্য একজন করে টিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯.শিশুকে শেখানো হবে কি বললে বা করলে সে বুঝবে এখন তাকে থামতে হবে বা কাজটা করতে হবে। এর জন্য ছোট ছোট প্রম্পট ব্যবহার করা।যেমনঃথামো,করো,ভাবো।
১০. শিশুরা যাতে বিভিন্ন সামাজিক দক্ষতাগুলো অর্জন করতে পারে এর জন্য ক্লাসরুমে হঠাৎ হঠাৎ কিছু প্রোগ্রামের আয়োজন করা।
১১. ক্লাস নোটের শিক্ষার্থীদের প্রতিলিপি প্রদান করা বা নোট গ্রহণে সহায়তা করার জন্য একটি "অধ্যয়ন বদি" বরাদ্দকরণ।
আরো পড়ুনঃ
বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশ কোনগুলো?
ODD (Oppositional Defient Disorder):
ODD হলো এক ধরনের আচরণগত মানসিক ব্যাধি।এটি বেশির ভাগ সময়ই শৈশব কালে লক্ষ্য করা যায় বা নির্ণয় করা যায়। ODD যুক্ত শিশুরা সহকর্মী,পিতা মাতা, শিক্ষক এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিদের প্রতি অসহযোগী বিদ্বেষী বিপরীতমুখী এবং অসন্তোষজনক আচরণ করে থাকে।
ODD আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষণ শেখানো কৌশলঃ
১.ODD আক্রান্ত শিশুদের যেহেতু মেজাজের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে না তাই তাদের মতামতের প্রাধান্য দিয়ে শেখাতে হবে।
২. তাদেরকে কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যে আবদ্ধ না করে ক্রমান্বয়ে সহজ নিয়মের মধ্যে রাখতে হবে।
৩. শিশুরা কি কারণে রেগে যায় সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে (ক্ষুধা,একঘেয়েমি,ক্লান্তি, বিষন্নতা ও অতিরিক্ত উত্তেজনা) এবং তা সমাধানে চেষ্টা করা।
৪. দিনের প্রত্যেকটা কাজ সময়মত হলে বাচ্চার মেজাজ ঠিক থাকে।তাই ক্লাসরুমে অপ্রাসঙ্গিকতা পরিহার করতে হবে। যথা সময়ে ক্লাস। টিফিন ও ছুটি দেওয়া।
৫. বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করার প্রবণতা জাগ্রত করতে হবে।
৬. সত্য কথা বলার জন্য পুরষ্কার বা সবার সামনে প্রশংসা করতে হবে যাতে তাদের মধ্যে নৈতিক ধারণার জন্ম নেয়, নিজের দোষ,ভুল ত্রুটিকে অন্যের উপর না দিয়ে থাকে।
CD (Conduct Disorder):
Conduct Disorder শৈশবের একটি দীর্ঘমেয়াদী মানসিক রোগ।সাধারণত ১৫ বছর বা তার চেয়ে কমে বয়সের কিশোর কিশোরীরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়।যেটি জনসংখ্যার শতকরা ১ভাগ এই মানসিক সমস্যা শিকার।
এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা আক্রমনাত্নক, ধ্বংসাত্নক,প্রতারণামূলক আচরণ করে থাকে।
Conduct Disorder শিশুদের শিখন কৌশলঃ
১.যেসব শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মারামারি করে,ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, ক্লাসে কোলাহল করে তাদেরকে ক্লাস ক্যাপ্টন বানাতে হবে যাতে তারা অন্যদের শাসন করার আগে নিজেরাই তাদের আচরণ ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
২. প্রেষণা হলো সকল কাজের মূল উৎস। তাই শিক্ষার্থীদের সর্বাধুনিক তথ্যের পরিবেশনা করে প্রেষণা সৃষ্টি করতে হবে।
৩. শিক্ষণ শেখানোর আগে তাদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে মনোযোগী করে তুলতে হবে।
৪. ভুল করলে তাদের শাস্তি না দিয়ে শুধরে দেওয়া এবং তার কাজের ইতিবাচক ও নেতিবাচক সম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে তা বোঝানো।
৫. তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে, প্রশংসা করতে হবে, শেখার অগ্রগতি জানাতে হবে, কি করলে আরো ভালো হবে সেই পরামর্শ দিতে হবে।
৬. বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে মিল রেখে শেখাতে হবে যাতে সে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পেরে খুশি হয় এবং পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হয়।
৭. যেহেতু এটি বয়ঃসন্ধিকালে হয়ে থাকে তাই এই সময়ে যে পরিবর্তনগুলো হয় সেগুলো বলতে হবে এবং তার সমাধান শিখিয়ে দিতে হবে।
৮. ভালোবাসার অভাব, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রগুলোতে সমস্যা থাকার কারণে Conduct Disorder হয়ে থাকে তাই শিশু মনকে ভালোভাবে বুঝতে হবে।
৯. শিশুরা যা দেখে তাই শেখে তাই তাদের সামনে কোনো অসদাচরণ করা যাবে না। যেমনঃ মিথ্যা বল, নিন্দা করা।
OCD (Obsessive Compulsive Disorder):
OCD হলো এমন এক ধরনের রোগ যেখানে obsessive অথবা compulsion বা ২টিই থাকতে পারে। Obsession হলো এক ধরনের মর্মপীড়াদায়ক চিন্তা, ছবি অথবা তাড়না, যা ইচ্ছের বিরুদ্ধে আসে।এই চিন্তা ভাবনা গুলো বিভিন্ন হয়, সময় পরিবর্তিত হয় এবং যুক্তির ধার ধারে না।আর compulsion হলো obsession এ প্রভাবিত হয়ে এবং অস্বস্তি উদ্বেগ বোঝানোর জন্য যে কাজ করা হয়।একে বাংলায় শুচিবাই বলা হয়।
আমরা ইতিমধ্যে অবগত হয়েছি যে,আচরণগত অক্ষম শিশুরা একটু জেদি,বিপরীতমুখী স্বভাবের হয়ে থাকে।তাই তাদের সাথে যতটা সম্ভব মিল রেখে তাদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে শেখালে তারা ভালো শিখবে।
আচরণগত অক্ষম শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে শিক্ষকের ভূমিকাঃ
- শিক্ষক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহায়ক, পরামর্শদানকারী,নির্দেশক।
- আন্তরিক সম্পর্ক রাখা,অন্তরঙ্গ থাকা
- ভয়ভীতিহীন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
- শিক্ষার্থী বিরুদ্বাচরণ করলে তাকে বোঝাতে হবে।
- Gang Age এর ফলে শ্রেণীকক্ষে দলবদ্ধ হয়ে খারাপ কাজে যুক্ত হয়ে থাকে। তাই শিক্ষকের খেয়াল রাখতে হবে শ্রেণীকক্ষে কি ধরণের গ্রুপ আছে এবং তারা যে কোনো ধ্বংসাত্মক কাজে যুক্ত হচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখা।
- ভালো কাজে ব্যস্ত রাখা, ফলে খারাপ কাজের সুযোগ পাবে না।
- Co- curriculum activities এর সাথে যুক্ত রাখা।
কোন মন্তব্য নেই