জোহান ফ্রেডরিক হার্বার্ট ও তার শিক্ষা দর্শন || Educational philosophy of Johan F. Herbert|
অষ্টাদশ শতাব্দীর নীরস শৃঙ্খলাভিত্তিক শিক্ষার প্রতিবাদে রুশো শিক্ষাজগতে যে আলোড়ন শুরু করেছিলেন এবং শিক্ষার নতুন নীতি নির্ধারণ করেছিলেন, পেস্তালাৎসী পরীক্ষার ভিত্তিতে সেই আলোড়নের বাস্তব রূপায়ণে সচেষ্ট হয়ে আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলেছিলেন। pestalozzi পরে তারই ভার যোহান ফ্রেডরিক হার্বার্ট, লকের দার্শনিক-মতবাদ, রুশোর প্রকৃতিবাদ, এবং পরীক্ষাভিত্তিক মনোবিদ্যার সংস্থাপন ঘটিয়ে নতুন শিক্ষানীতি এবং শিক্ষণপদ্ধতি গঠনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম শিক্ষার একটি সম্পূর্ণ দর্শনভিত্তিক মতবাদ এবং শিক্ষাপদ্ধতির একটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
![]() |
Educational Psychology of Herbert. |
॥ হার্বার্টের জীবনদর্শন ॥
রুশো, কান্ট, পেস্তালাসী ইত্যাদী মনীধীদের চিন্তাধারার দ্বারা হার্বাটের জীবনদর্শন প্রভাবিত হয়েছিল। তিনি তার পূর্বসূরীদের চিন্তাধারার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন চিন্তাধারার সূত্রপাত করেছিলেন। তিনি একইসঙ্গে ছিলেন দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। দার্শনিক হিসাবে তিনি মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মানুষের অন্তর্জগতের স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশেকে নীতিজ্ঞান হিসাবে বর্ণনা করেছেন (the idea of inner freedom which has developed into abiding actuality in an individual)।
॥নীতিজ্ঞান॥
তাঁর দর্শন কান্টের চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত। মানুষকে আত্মপ্রতিজ্ঞ (Self-determined) হতে হলে এই নীতিজ্ঞানের প্রয়োজন। এই নীতিবোধ জন্মগত হলেও তার সুষম বিকাশ হয় জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এই বিকাশকে সুসম্পূর্ণ করার জন্য সুশিক্ষা প্রয়োজন। অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ন ও তাদের সুশৃঙ্খল বিন্যাসের উপর নির্ভর করছে এই নীতিজ্ঞানের বিকাশ।
শুধুমাত্র নীতিজ্ঞান নয়, সৌন্দর্যবোধও হার্বাটের জীবনের আদর্শ ছিল। যা সত্য, তাই সুন্দর। তিনি সত্য-সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে এবং অসুন্দরের প্রতি ঘৃণার ভাব জাগ্রত হওয়াকেই জীবনের আদর্শ হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন-- "Aesthetics elaborates the ideas involved in the expression of taste called forth by those relations of objects wideh acquire for them the attribute of beauty or the reverse."
মনে করতেন, মানুষের ইচ্ছাশক্তি (Will) মানুষের কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই শক্তি আত্মজ্ঞ। কিন্তু হার্বার্ট বললেন, এই ইচ্ছাশক্তি মানুষের অভিজ্ঞতার প্রভাবমুক্ত নয় । মনোবিদ হিসাবে হার্বাট মনের এককত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর এই মতবাদ প্রাচীন মানসিক শক্তিবাদ (Faculty Psychology) থেকে ভিন্ন। প্রাচীনপন্থীরা মনকে কতকগুলি
পরস্পর-নিরপেক্ষ শক্তি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু হার্বাট বললেন, মনের মধ্যে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হলেও সেখানে বৈচিত্রের মধ্যে এক সমন্বয়মূলক প্রক্রিয়া কাজ করছে। সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার সামগ্রীকে একীভূত করে মন এক সামঞ্জস্যপূর্ণ সংগঠন গড়ে তুলছে সব সময়। অন্যদিকে তিনি লক্ (Locke)-এর মত বিশ্বাস করতেন, মন বা আত্মা কোন বিশেষ গুণ নিয়ে জন্মায় না, জন্মের সময় মন থাকে একেবারে সাদা কাগজের মত ফাঁকা। মনরো (Monroe) হার্বার্টের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন— "To Herbart, the soul is a unity not endowed with inhorn facelties but blank at birth. possessing but the one power of entering into relation with the environment" হার্বার্ট, লক্-এর মানসিক শূন্যতা মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। লক-এর নির্ধারিত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়নের প্রক্রিয়াতেও তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। লক বলেছেন— External perception and internal perception are the two windows through which the light of the external world penetrates into the dark chamber of Mind - হার্বাট ও মনে করেন বহির্জগতের উদ্বোধক (Stimulus), ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মনের উপর ক্রিয়া করলে, চেতনার (Consciousness) ক্ষুদ্রতম উপাদান হিসাবে ভাবের (Idea) উদয় হয়। ভাবগুলি নিষ্ক্রিয় নয়: এর গতিধর্মী এবং তাদের গতিধর্মীতার দরুন তারা আত্মসংরক্ষণে সচেষ্ট হয়। এর পর এই প্রাথমিক জ্ঞানগুলি মনের মধ্যে সামান্যীকরণ (Generalization). বিচারকরণ (Judgement ) ও যুক্তিকরণ (Reasoning) প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াকে জাগ্রত করে। এইভাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়।
Related:জোহান হেনরিক পেস্টালজি ও তার শিক্ষাদর্শন।
॥অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ন॥
নতুন নতুন জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা কিভাবে সঞ্চয় করা হয়, সে সম্পর্কে আরও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হার্বার্ট বলেছেন, প্রাথমিক ইন্দ্ৰিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের ভিত্তি এই অভিজ্ঞতাগুলির পরে মনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ক্রিয়াশীলতার মাধ্যমে সংযুক্ত বা বিযুক্ত হয়। যেগুলি সমধর্মী, সেগুলি অভিজ্ঞতাকে দৃঢ়তর করে এবং চেতন মনের উপাদানের সৃষ্টি করে। এইসব অভিজ্ঞতা পারস্পরিক সংযুক্তির মাধ্যমে একটি পুষ্পের (system) সৃষ্টি করে। একেই বলা হয় ‘অভিজ্ঞতা-পুঞ্জ' (Apperceptive mass)। ব্যক্তি কোন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে, তার 'অভিজ্ঞতা-পুঞ্জ' নতুন অভিজ্ঞতাকে এই পুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়াসী হয়। যদি এই সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়, তাহলেই মন এই নতুন অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করবে। পুরাতন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অভিজ্ঞতাকে মনে স্থান দেওয়াকে মনোবিদ্যায় 'অ্যাপারসেপ্সান' (Apperception) বলা হয়। [ Apperception is the assimilation of ideas involved in relationship of a new experience by means of ideas already acquired.]
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মনের দু'টি বৈশিষ্ট্যের উপর হার্বার্ট গুরুত্ব আরোপ করছেন—
- মনের গ্রহণধর্মীতা
- মনের সমন্বয়ী প্রকৃতি
যে পদ্ধতিতে মন অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে অতীত অভিজ্ঞতা-পুঞ্জের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করে। হার্বাটের শিক্ষানীতি তার মানুষের মনসংক্রান্ত এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
॥শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষাদর্শন॥
• হার্বাটের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষার লক্ষ্য (Herbart's Philosophy of Education and Aim of Education)
হার্বার্টের শিক্ষাদর্শন তার দার্শনিক চিন্তা এবং মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত। মনে শিক্ষার মূল ভিত্তি হল নীতিজ্ঞান (Morality) মানুষকে অন্তনিহিত দিয়ে তার আত্মকর্তৃত্বের বোধ জাগ্রত করে। এই নীতিজ্ঞান মানুষের জন্মগত সম্পন হলেও শিক্ষার আপাতঃ লক্ষ হার্বাট বলেছেন অভিজ্ঞতার দ্বারা তার বিকাশ করা যায়। তাই তাঁর কাছে শিক্ষার লক্ষ্য হল মনের সামনে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপস্থাপন করে এই নীতিবোধ বিকাশের সহায়তা করা। মানসিক শক্তিবাদে অবিশ্বাসী হার্বার্ট মনে করতেন, এই অভিজ্ঞতাগুলি পরস্পরবিচ্ছিন্ন অবস্থায় মনের মধ্যে থাকতে পারে না। নীতিবোধ নির্ভর করে অভিজ্ঞতার সুসামঞ্জস্য বিন্যাসের উপর। নীতিবোধকে স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত করাই হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য। মানুষ যেভাবেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করুক না কেন, অভিজ্ঞতা প্রাকৃতিক বা সামাজিক যে কোন শক্তির প্রভাবেই আসুক না কেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর ভাবে তাদের মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত করা এবং একটি স্থায়ী কেন্দ্রের অধীনে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখানো। মানুষের সৎ ও অসৎভাব নির্ভর করে, তার অভিজ্ঞতা অর্জন ও অভিজ্ঞতার সংগঠন ও কেন্দ্রীকরণের উপর। শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতার পরিধি (Circle of thought) নির্ধারণ করা। হার্বার্ট বলেছেন নীতিবোধ (Morality) নির্ভর করে সং ইচ্ছাশক্তির (Good will) ও জ্ঞানের (Knowledge) উপর। আবার নীতিবোধ নির্ভর করে প্রাথমিক অভিজ্ঞতার (Primary presentation) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর। তাই শিক্ষার আপাতঃ লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীর প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করা।
অন্যদিকে হার্বার্ট শিক্ষার চরম লক্ষ্য হিসাবে নীতিবোধ বা চরিত্র গঠনকে স্থির করেছেন। শিশুর একক অভিজ্ঞতাকে অভিজ্ঞতাপুরের (Apperceptive mass) সক্রিয়তার দ্বারা পরিবর্তন করতে পারলে চরিত্র গঠিত হবে। তাই তিনি শিক্ষার চরম লক্ষ্যে উপস্থিত হওয়ার জন্য অভিজ্ঞতাপুঞ্জের সক্রিয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব নিয়েছেন। এখানে তিনি তার মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করেছেন। তিনি মনে করেন— অভিজ্ঞতাপুঞ্জের সক্রিয়তা শিশুর অনুরাগের উপর নির্ভর করে। তাই তিনি বলেছেন, শিক্ষার কাজ হবে, শিশুর বহুমুখী অনুরাগের শিক্ষার চরম লক্ষ (Interest) বিকাশসাধন করা। আগ্রহ হল অতি অভিজ্ঞতার দ্বারা নতুন
অভিজ্ঞতা গ্রহণের প্রবণতা বা প্রচেষ্টা। হার্বার্ট নিজে লক্ষ্য করেছেন যে, যে বিষয়ে শিশু অনুরাগী, সে বিষয়গুলি সে ভাড়ানাড়ি শিখতে পারে। অনুরাগ যে বিষয়ের প্রতি নেই, সে বিষয় সে শিখতে শিখতে পারে না। এতদিন পর্যন্ত শিক্ষাবিদদের ধারণা ছিল, শিশুর অনুরাগ তার খেয়ালখুশি মত সৃষ্টি হয়। কিন্তু হার্বার্ট তার অনুরাগের তত্ত্বে (Theory of interest) ভিন্ন মতবাদ স্থাপন করলেন। শিক্ষা শিশুকে শুধুমাত্র কতকগুলি তথ্য (Information) সংগ্রহে সহায়তা করবে তাই নয়, এইসব তথ্যের দ্বারা তার মধ্যে নতুন নতুন অনুরাগেরও সৃষ্টি করবে। শিশুর মধ্যে বহুমুখী অনুরাগ সৃষ্টি করা হবে শিক্ষার চরম লক্ষ্যে পৌঁছানোর কৌশল।
হার্বার্ট বলেছেন, এই অনুরাগের আবার দুটি দিক আছে—ব্যক্তিকেন্দ্রিক (Subjective) এবং বঙ্গকেন্দ্রিক (Objective)। শিক্ষার আপাতা উদ্দেশ্য হবে এই বস্তুকেন্দ্রিক অনুরাগ সৃষ্টি করা। বজ্রপাতের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে ক্রিয়ার মাধ্যমে যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়, তাকেই তিনি বলেছেন বস্তুকেন্দ্রিক অনুরাগ।
॥ হার্বাটের পাঠ্যক্রম(Herbart's Curriculum)॥
হার্বার্টের পাঠ্যক্রম সাধারণতঃ দুটি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে আছে—কৃষ্টি-যুগতত্ব (Culture epoch theory) এবং অনুরাগ-তত্ত্ব (Theory of interest)। তিনি মনে করেন, শিশুর নীতিবোধ জাগ্রত করতে হলে, মনুষ্যসভ্যতার যথার্থ মূল্যায়িত রূপ তার সামনে তুলে ধরতে হবে। সুদীর্ঘকাল ধরে বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করে মানবসভ্যতা পাঠ্যক্রম নির্ধারণে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, মানবকৃষ্টির যে বিকাশসাধন করেছে, তার সমস্ত উপাদান শিশুর সামনে পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।
অর্থাৎ, পাঠ্যক্রমে ইতিহাসকে প্রধান স্থান দিতে হবে। জাতির বিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে
শিশুর পাঠ্যক্রম রচনা করতে হলে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত : পাঠ্যক্রমের মধ্যে এমন বিষয় নির্বাচন করতে হবে, যাদের মাধ্যমে শিশুর বহুমুখী অনুরাগ (Many-sided interest) চরিতার্থ হয়। শিশুর স্বাভাবিক অনুরাগ বিশ্লেষণ করে তিনি শিক্ষণীয় বিষয়কে দু'ভাগে ভাগ করেছেন :
- সামাজিক বা ঐতিহাসিক অনুরাগ সংক্রান্ত বিষয় এর মধ্যে থাকবে ইতিহাস,ভাষা এবং সাহিত্য।
- বৈজ্ঞানিক অনুরাগ সংক্রান্ত বিষয়- এর মধ্যে থাকবে সাধারণ বিজ্ঞান, গণিত ও কারিগরী বিদ্যাসমূহ পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু নির্বাচনের সময় প্রতিক্ষেত্রেই মানসিক সামঞ্জস্যের কথাও চিন্তা করতে হবে।
কারণ, শিশুর মনে বিচ্ছিন্ন জ্ঞানের কোন মূল্য নেই। তাই শিক্ষাকে মনোধর্মী করতে হলে এমন বিষয় নির্বাচন করতে হবে যেগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং যেগুলি সহজভাবে শিশুর অভিজ্ঞতাপুঞ্জের মধ্যে মিশে যেতে পারে।
॥ হার্বার্টের শিক্ষণপদ্ধতি ॥
(Herbart's Method of Instruction) হার্বাটের প্রস্তাবিত শিক্ষণপদ্ধতি তাঁর শিক্ষাদর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনিই শিক্ষাজগতে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাদানের পদ্ধতি নির্ধারণ করেন।
অনুবন্ধের তত্ত্ব (Theory of Correlation: এই তত্ত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয়গুলিতে শিক্ষার্থীর সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে সে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। পরস্পরবিচ্ছিন্ন বিষয় মন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ইতিহাসের সঙ্গে ভূগোলের, ভূগোলের সঙ্গে অঙ্কের ,অঙ্কের সঙ্গে বিজ্ঞানের ,বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রকৃতি পরিচয়ের যে সম্পর্ক আছে তা উপলব্ধি করতে শিক্ষার্থীকে সহয়তা করতে হবে। অন্যদিকে পড়ার সঙ্গে উচ্চারণ ও লেখার যে সম্পর্ক আছে, তাও শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে হবে। হার্বাট মনের এককত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই তিনি এই পদ্ধতির উপর আস্থা প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে সামান্যীকরণ হার্বার্টের শিক্ষণপদ্ধতির মূল কথা। তাঁর এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মনরো বলেছেন, “Such instruction, then which modifies the groups of ideas already possessed by the mind causing them to form a new unity or harmonious series of unity and which thus determines conduct, is alone educative."
তাঁর এই অনুবন্ধের তত্ত্বের সঙ্গে অনুরাগের তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবে যুক্ত। বিষয়বস্তু যদি সুসংবদ্ধ না হয়, তাহলে শিক্ষার্থীর বহুমুখী অনুরাগ সৃষ্টি করতে তা সক্ষম হবে না। যে শিক্ষা শিক্ষার্থী অনুরাগ সৃষ্টি করতে পারে না, সে শিক্ষণপদ্ধতির দ্বারা শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। তিনি বলেছেন, “The word interest stands in general for that kind of mental activity which is the business of the instruction to incite.” শিক্ষণপদ্ধতি বা শিক্ষকের কাজ হবে শিশুর বহুমুখী অনুরাগের সঙ্গে তার ব্যক্তিসত্তাকে যুক্ত করা।
॥অনুবন্ধ ও আগ্রহের তত্ত্বের সোপান॥
শিক্ষার উদ্দেশ্যসাধনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষণপদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা হার্বার্ট উপলব্ধি করেছিলেন। শিশুর মনের সুসামঞ্জস্য বিকাশের জন্য এই ধরনের পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার কথা আধুনিককালে সকল শিক্ষাবিদ স্বীকার করেছেন। এই পদ্ধতি নির্ণয়ে হার্বাট চার রকমের মানসিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগ্রহ থেকে চরিত্র গঠন হয়, তা হল- পর্যবেক্ষণ (Observation).
শিক্ষণপদ্ধতির বিভিন্ন সোপান
প্রত্যাশা (Expectation). তাগিদ (Demand), এবং ক্রিয়া (Action ) ।
সুতরাং শিক্ষণপদ্ধতিতেও এরকম চারটি সোপান থাকবে। এই সোপানগুলি হল –
(১) অভিজ্ঞতার সুস্পষ্টতা (Clearness)
(2) অভিজ্ঞতার সংযোগ(Association)
(৩) সমন্বয় সাধন (System)
(৪) সূত্র নির্ণয় (Method)।
অভিজ্ঞতার সুস্পষ্টতা বলতে তিনি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করাকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীর বিশেষ বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করে দেখবে। শিক্ষণপদ্ধতির দ্বিতীয় পর্যায়, সংযোগ স্থাপনের (Association) স্তরে, পূর্বের পর্যবেক্ষণের দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানকে শিক্ষার্থীর অতীত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়ে নেবে প্রাথমিকভাবে। পরে, তৃতীয় পর্যায়ে আরও বৃহত্তম সমন্বয়ের মাধ্যমে ঐ বিষয়সংক্রান্ত সাধারণ ধারণাকে অতীত ধারণাপুঞ্জের সঙ্গে একত্রিত করবে। এই স্লোগানের নাম হল সম্বনয়ন System) স্তরে, শিক্ষার্থী প্রয়োগের মাধ্যমে তার নতুন অভিজ্ঞতাকে আরও সামানীকরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
Related:চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস ও তার শিক্ষাদর্শন|
Written By:MD Shakil Shah
![]() |
Shakil Shah |
আমি শাকিল হোসেন শাহ। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নরত আছি। টুকটাক ওয়েব এ লিখতে ভালোবাসি।
কোন মন্তব্য নেই